ইন্টারনেটের জনক কে? এই প্রশ্ন হয়তো অনেকের মনেই জাগে, বিশেষ করে যারা প্রযুক্তির পেছনের গল্প জানতে আগ্রহী। ইন্টারনেট বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তিগত উন্নয়নগুলোর একটি, যা পৃথিবীকে এক ধরণের ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বা বিশ্বগ্রামে পরিণত করেছে। এটি শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয় বরং শিক্ষা, ব্যবসা, গবেষণা, এবং দৈনন্দিন জীবনের সবক্ষেত্রেই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু ইন্টারনেটের এই বিপ্লব কি হঠাৎ করেই শুরু হয়েছিল? নাকি একক কোনো ব্যক্তির হাতে এই প্রযুক্তির জন্ম হয়েছিল? উত্তর হলো—না। ইন্টারনেটের পেছনে রয়েছে বহু বিজ্ঞানী ও গবেষকের যুগান্তকারী গবেষণা, প্রচেষ্টা ও আবিষ্কারের গল্প।
এই লেখার মধ্যেমে আমরা জানবো ইন্টারনেটের জনক কে, তাদের অবদান কী ছিল, এবং কীভাবে ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছিল আজকের আধুনিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা।
ইন্টারনেটের জনক কে?
ইন্টারনেটের জনক বলতে সাধারণত দুইজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়, যারা আধুনিক ইন্টারনেট প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তারা হলেন:
- ভিন্টন সার্ফ (Vinton Cerf)
- রবার্ট কান (Robert Kahn)
ভিন্টন সার্ফ (Vinton Cerf)
ভিন্টন সার্ফকে অনেকেই “ইন্টারনেটের পিতা” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১৯৭০-এর দশকে তিনি রবার্ট কানের সঙ্গে একত্রে কাজ করে TCP/IP প্রটোকল তৈরি করেন, যা বিভিন্ন কম্পিউটার নেটওয়ার্ককে একত্রে সংযুক্ত করার মূল প্রযুক্তি।
এই প্রোটোকলের মাধ্যমে ইন্টারনেট একটি গ্লোবাল নেটওয়ার্কে পরিণত হওয়ার রাস্তা খুঁজে পায়।
রবার্ট কান (Robert Kahn)
রবার্ট কান ছিলেন TCP/IP ধারণার মূল প্রবর্তক এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা গবেষণা প্রকল্প ARPANET-এর অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী। তিনি ভিন্টন সার্ফের সঙ্গে যৌথভাবে TCP/IP প্রটোকল ডিজাইন ও বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন, যা ইন্টারনেটের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
তাদের অসামান্য অবদানের জন্য ২০০৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ তাদেরকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার, “Presidential Medal of Freedom”, প্রদান করেন।
ইন্টারনেটের ইতিহাস সংক্ষেপে
ইন্টারনেটের ইতিহাস বহু বছর আগের হলেও, আধুনিক ইন্টারনেটের ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে। এই সময়কালের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক রয়েছে, যা আধুনিক ইন্টারনেটের বিকাশে পথিকৃত হয়ে উঠে।
ARPANET: ইন্টারনেটের যাত্রা
১৯৬৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা DARPA চালু করে ARPANET, যা ছিল বিশ্বের প্রথম কার্যকরী কম্পিউটার নেটওয়ার্ক।
ARPANET-এর মূল লক্ষ্য ছিল দূরবর্তী বিভিন্ন কম্পিউটারের মধ্যে দ্রুত ও নিরাপদ ডেটা আদান-প্রদান নিশ্চিত করা।
এটি ছিল প্যাকেট সুইচিং প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যেখানে ডেটা ছোট ছোট প্যাকেটে বিভক্ত হয়ে দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারে।
TCP/IP প্রোটোকলের বিকাশ
ARPANET-এর সফলতার পর ১৯৭৩ সালে ভিন্টন সার্ফ ও রবার্ট কান একযোগে কাজ শুরু করেন একটি নতুন যোগাযোগের প্রটোকল তৈরি করার জন্য, যাকে বলা হয় TCP/IP।
১৯৮৩ সালে অফিসিয়ালি TCP/IP প্রটোকল ARPANET-এ প্রয়োগ করা হয়, যা আধুনিক ইন্টারনেটের সূচনা হিসেবে গণ্য।
TCP/IP বিভিন্ন আলাদা নেটওয়ার্ককে একত্রিত করে একক, বৃহৎ ও কার্যকরী ইন্টারনেট গঠন করতে সাহায্য করে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW) আবিষ্কার
১৯৮৯ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী টিম বার্নার্স-লি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW) আবিষ্কার করেন।
তিনি প্রথম ওয়েব ব্রাউজার ও হাইপারলিংক প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেন, যা ইন্টারনেটকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলে।
WWW-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট তথ্য অনুসন্ধান, যোগাযোগ ও বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে পরিণত হয়।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীরা
ইন্টারনেটের বিকাশে অনেক বিজ্ঞানীর অবদান রয়েছে, যাদের গবেষণা ও উদ্ভাবন আধুনিক ইন্টারনেট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন বিশেষভাবে স্মরণীয়:
লিওনার্ড ক্লেইনরক (Leonard Kleinrock)
তিনি প্যাকেট সুইচিং তত্ত্বের জনক।
ARPANET ডিজাইনের অন্যতম সূচনা করেন, যা তথ্যের ক্ষুদ্র প্যাকেটে ভাগ করে দ্রুত প্রেরণের ভিত্তি স্থাপন করে।
লরেন্স রবার্টস (Lawrence Roberts)
ARPANET-এর প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন তিনি।
প্রথম ARPANET নোড সেটআপ করেন এবং নেটওয়ার্ক আর্কিটেকচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
টিম বার্নার্স-লি (Tim Berners-Lee)
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW)-এর জনক।
প্রথম ওয়েব ব্রাউজার এবং হাইপারলিংক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন, যা ইন্টারনেটকে ব্যবহারকারীর জন্য সহজলভ্য ও কার্যকর করে তোলে।
ইন্টারনেটের গুরুত্ব ও আমাদের জীবনে প্রভাব
ইন্টারনেট বিশ্বব্যাপী তথ্যের প্রবাহকে অত্যন্ত দ্রুত, সহজ এবং সুলভ করেছে। এর মাধ্যমে যোগাযোগ, শিক্ষা, ব্যবসা, চিকিৎসা, বিনোদনসহ জীবনের নানা ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত খুলে গেছে।
তথ্যপ্রাপ্তি ও যোগাযোগ: মুহূর্তে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে তথ্য সংগ্রহ ও মানুষের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব।
শিক্ষা: অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম ও রিসোর্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই বিশ্বমানের শিক্ষা পেতে পারে।
ব্যবসা: ই-কমার্স ও ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে ব্যবসা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে।
চিকিৎসা: টেলিমেডিসিন ও স্বাস্থ্য তথ্য শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা আরও সহজ ও দ্রুত হয়েছে।
বিনোদন: অনলাইন মিউজিক, সিনেমা, গেমিংসহ নানা বিনোদন উপভোগ করা যায়।
ইন্টারনেট মানুষের জীবনযাত্রার মানকে পরিবর্তন করেছে এবং বিশ্বকে আরও সংযুক্ত, স্বচ্ছ ও তথ্যভিত্তিক করে তুলেছে ।
পরিশেষে:
ইন্টারনেটের জনক কে? এই প্রশ্নের আসলে সরল কোন উত্তর নেই, কারণ এটি একাধিক বিজ্ঞানীর যুগপৎ কাজের ফল। তবে ভিন্টন সার্ফ ও রবার্ট কানের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাঁদের TCP/IP প্রটোকল আধুনিক ইন্টারনেটের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
আমরা যেভাবে এখন তথ্য বিনিময় করি, বিশ্বকে একত্রে নিয়ে আসি, তা সম্ভব হয়েছে তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টার কারণে।
তাই প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের এই মহান অর্জনকে সম্মান জানানো উচিত, যারা যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছেন।
প্রাসঙ্গিক প্রশ্নোত্তর (FAQs)
১. ইন্টারনেটের জনক কে?
ভিন্টন সার্ফ ও রবার্ট কান, যাঁরা TCP/IP প্রোটোকল তৈরি করেন।
২. ইন্টারনেট কবে আবিষ্কার হয়?
মূল প্রকল্প ARPANET শুরু হয় ১৯৬৯ সালে।
৩. TCP/IP কী?
নেটওয়ার্কের মধ্যে যোগাযোগের নিয়মাবলী, যা ইন্টারনেট গঠন করে।
৪. WWW কে আবিষ্কার করেন?
টিম বার্নার্স-লি, ১৯৮৯ সালে।
৫. ইন্টারনেটের উপকারিতা কী?
তথ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ ও ব্যবসায় সহজতা এনেছে।
আরো দেখুন:
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ: ব্যবহারের সুবিধা ও বেছে নেওয়ার সঠিক উপায়
ইন্টারনেট কি? সহজ ভাষায় ইন্টারনেটের ধারণা ও ব্যবহার
ইন্টারনেট স্পিড: কমে যাওয়ার কারণ ও সমাধান জেনে নিন
রাউটার কি? কাজ ও ব্যবহার সহজ ভাষায় জানুন
Comments
Post a Comment
মতামত জানান